একজন শাহীন সরকার। প্রকৃতির সাথেই যার প্রেম অতোপ্রতো ভাবে। কখনো পাখির অভয়াশ্রম করা, কখনো বিপদগ্রস্ত বিপন্ন প্রাণীকে উদ্ধার করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা, কখনো আবার নিজ উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করা। এবার আট দিনে রাস্তার দুই পাশে আট কিলোমিটার জুড়ে ১৫ হাজার তাল বীজ রোপন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন প্রকৃতিপ্রেমী শাহীন।
শাহীন সরকার তার সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গা জেলার তিতুদহ ইউনিয়নের ৬২নং আড়িয়া গ্রামের মাঠ থেকে শুরু করে বলদিয়া পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে ২ হাজার পিস তাল বীজ রোপন কার্যক্রম শুরু করেন। এরপর সাত দিনে ধাপে ধাপে আরো ১৩ হাজার তাল বীজ রোপন করেন। এরআগে জেলার বিভিন্ন জায়গা ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে তাল বীজ সংগ্রহ করেন শাহীন ও তার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা।
এছাড়াও পাখির প্রতি ভালোবাসায় ৫ বছরের প্রচেষ্টায় ৬২নং আড়িয়া গ্রামটিকে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলেছেন শাহীন সরকার। গ্রামে প্রবেশ করতেই রাস্তার পাশে চোখে পড়বে সাইনবোর্ড যেখানে লেখা আছে, ‘পাখি ও বন্যপ্রাণীর মুক্ত অভয়াশ্রম। এখানে সকল প্রকার পাখি ও বন্যপ্রাণী শিকার, আটক, হত্যা, ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ’।
শিকারি আর কিটনাশকের উৎপাতে গ্রাম থেকে যখন পাখিদের বিতারিত করতে মত্ত এক শ্রেণির মানুষ ঠিক তখনই পাখি নিধঁনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তরুণ প্রকৃতিপ্রেমী শাহীন সরকার। গ্রামের তরুণদের নিয়ে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মনবতার জন্য’ । তাদের পরিকল্পনায় পাখিদেরকে গ্রামে ফিরিয়ে আনতে গাছে গাছে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয় পাখিদের আবাস্থল। পাখি শিকার নিষিদ্ধ থাকায় বাবুই পাখি, দোয়েল, কোয়েল, শ্যামা, টিয়া, ঘুঘু, ফিঙে, শালিক, প্যাঁচা, শামুকখোল, বক, চন্দনা টিয়া, মাছারাঙাসহ রঙবেরঙের দেশি বিদেশি বিরল সব পাখি নির্ভয়ে ঘুড়ে বেড়ায় গ্রাম জুড়ে। সেই সঙ্গে বুলবুলি, হলুদ চোখ ছাতা ও জলময়ূরেরও ইদানিং দেখা মেলে এই গ্রামে।
শুধু কি পাখি? বন্য প্রাণীদের জন্যও অভয়াশ্রম এই ৬২নং আড়িয়া। গ্রামের মাঠে গেলেই এখন দেখা মেলে খরগোশ, বনবিড়াল, বাগডাশ, মেছো বাঘ ও শিয়ালের। মন কাড়ে ধানখেতে পার্চিং হিসেবে পুঁতে রাখা ডালে বসে পাখিদের দোল, ঝোপঝাড়গুলোতে খরগোশ ও বেজির আনাগোনা, গাছের শরীর বেয়ে কাঠবিড়ালি ও গিরগিটির চঞ্চলতা। আবার মাঝে মাঝে দেখা মেলে হুনুমান দলেরও।
কিছুদিন আগেই জেলা সদরের নেহালপুরে একটি মেছো বিড়ালের (বাগডাশ) ছানা লোকালয়ে এসে গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে। অনেকেই সেটিকে মেরে ফেলতে উদ্যোগী হন। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান ‘মানবতার জন্য’ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। এরপর গ্রামবাসীর কাছ থেকে ছানাটিকে উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেন তারা।
এভাবেই গত পাঁচ বছরে তিনশোরও বেশি বিপদগ্রস্ত বিপন্ন প্রাণী ও শিকারির হাতে আটক বিভিন্ন প্রজাতির পাখি উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই সংগঠনের সদস্যরা। যার মধ্যে খরগোশ, শিয়ালছানা, বাগডাশ, গুইসাপ বনবিড়াল, বিভিন্ন প্রজাতির নির্বিষ সাপ, অতিথি ও স্থানীয় প্রজাতির পাখি।
একই সাথে সংগঠনটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পাখি ও বন্যপ্রাণী নিধন-শিকারের বিষয়ে নিরুৎসাহিত ও সচেতনতা তৈরি করছে। পাশাপাশি রাস্তার পাশে পাশে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে এলাকাবাসীকে উৎসাহিত করে এই সংগঠনটি।
শাহীন সরকার বলেন, আমরা গাছ লাগাই পৃথিবীর জন্য, আমরা গাছ লাগাই পাখিদের জন্য, আমরা গাছ লাগায় আমাদের জন্য।
তিনি আরো বলেন, বন্যপ্রাণী প্রকৃতির অলংকার। আমাদের দেশ, আমাদের মায়ের মতো। আর যদি এই মায়ের হাতে, গলায়, কানে অলংকার না থাকে তাহলে মায়ের দিকে তাকালে শূন্যতা অনুভব হয় তেমনি আমাদের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য হচ্ছে আমাদের দেশ মায়ের অলংকার। প্রকৃতিতে যদি বন্যপ্রাণী ও পাখি না থাকলে আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার ভিতর পড়ে যাবে ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই জন্য বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করি।
শুরুর দিকে মানুষ আমাকে ভবোঘুরে পাগল বলে সম্বোধন করলেও এখন আমাদের এলাকার মানুষ বুঝতে পেরেছে প্রকৃতিতে বন্যপ্রাণী ও পাখি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময়ে যারা আমাকে দেখে উপহাস করতো আজ তারাই আমার কাজে উৎসাহ দেয়। আমার কাঁধে কাধ মিলিয়ে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। আর এভাবেই আমি আমার কার্যক্রম করে যেতে চাই। শুধু গ্রাম নয়, জেলা, বিভাগ একটা সময় পুরো বাংলাদেশ নিয়ে।