বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তিনটি শক্তিশালী পক্ষ- আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতৃত্বে প্রায় সব বিরোধী দল এবং আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো এক অদম্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারকারী এবং গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত কোনো এক অদৃশ্য কারণে এতকাল চুপচাপ ছিল। কিন্তু এর মধ্যে ভারতের আনন্দবাজার, জার্মানির ডয়েচে ভেলে ও ঢাকার প্রথম আলো রিপোর্ট করেছে, ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে সরব হয়ে আমেরিকাকে আওয়ামী লীগের প্রতি আরও নমনীয় হতে বলেছে। ওই রিপোর্টগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনার প্রেক্ষাপটে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি রিপোর্টগুলো কল্পনাপ্রসূত বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার পরও যদি ওই রিপোর্টগুলোর সামান্য সত্যতা থেকে থাকে, আওয়ামী লীগের তাতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমেরিকার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, আমেরিকা কোনো পলিসি নির্ধারণে সব ধরনের প্রফেশনাল বিশ্লেষক রাখে, যারা সবকিছু চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ ভারত কী করতে বা চাইতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়েই তারা অগ্রসর হয়েছে। একুশের কিংবদন্তি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কালের কণ্ঠে তার নিয়মিত কলামে লিখেছিলেন, ভারতের সম্মতিতেই আমেরিকা র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আরও একটি বিষয় অনেকেরই মনে থাকার কথা, বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা নেওয়ার ১০ মাসের মাথায় ক্রিস্টিনা সেশন নামের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় পাঠিয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, এখন থেকে আমেরিকা আর ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখবে না, তারা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি দেখাশোনা করবে, যা পরের দিন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ভারত যে আওয়ামী লীগের পাশে থাকবে না তার প্রমাণ দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকস সম্মেলনে। তারা বাংলাদেশকে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার হুমকি এবং জিডিপি গ্রোথের অজুহাত তুলে ব্রিকসের সদস্যপ্রাপ্তিতে বাধা দিয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগটুকুও দেয়নি। এ থেকে এটুকু স্পষ্ট, আমেরিকা ভারতকে ম্যানেজ করেই এত দূর এসেছে। তার পরও আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেওয়ার দল নয়; তারা মরণপণ লড়াই করে যাবে, যদি না প্রধানমন্ত্রী নিজের মতের পরিবর্তন করেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, তিনটি পক্ষই বলছে, তারা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, আবার সবাই যে যার মতো শক্তি বা কৌশল নিয়ে মাঠে প্রস্তুত, অর্থাৎ নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। এই ত্রিমুখী প্রতিযোগিতায় কী ফলাফল হবে, তা স্পষ্ট করে বলা না গেলেও সম্ভাব্য তিনটি সিনারি কল্পনা করা যেতে পারে।
প্রথম দৃশ্যপট : একটি সমঝোতার নির্বাচন; এটার সম্ভাবনা ৭০%। এটা সম্ভব হবে এ কারণে যে আওয়ামী লীগ সরকারের সব টুলস, শক্তি ও কৌশল ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে যাবে। পশ্চিমারা, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্বলতম স্থানসমূহে এমনভাবে আঘাত করতে থাকবে যে আওয়ামী লীগ রক্তাক্ত হলেও করার কিছুই থাকবে না। ইতিমধ্যেই দু-একটি নিষেধাজ্ঞার আঘাতেই ১৫ আগস্টের শোকসভায় প্রধানমন্ত্রী আমেরিকাকে একহাত নিয়েছেন। এভাবে বক্তব্য দিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মী ও প্রশাসনকে উজ্জীবিত রাখা গেলেও আমেরিকাকে নিবৃত্ত করা যাবে না। বরং সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মতো তিনি আবারও এই অহেতুক দাবি করে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের আরও এক ধাপ অবনতি ঘটালেন। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন এক সেমিনারে বলেছেন, তিনি আবারও ১৫ আগস্টের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন এবং সামনে আরও কঠিন দিন আসছে বলে সবাইকে সতর্ক থাকতে বললেন। প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে পাওয়ারফুল উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও এক সভায় গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বললেন। আর সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদেরসহ ছোটখাটো নেতারা সব সময়ই ষড়যন্ত্রের কথা বলে যাচ্ছেন। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ভারত সফরে বা রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে চীন সফরে কোনো আশার বাণী পাওয়া যায়নি। বরং চীন প্রকাশ্যেই বলেছে, তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। অভ্যন্তরীণভাবে দীর্ঘ দিনের মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টিকে ২০১৪ সালের মতো ব্যবহার করতে পারার সম্ভাবনাও কম। জি এম কাদের ভারত ঘুরে কী বার্তা পেলেন, তা সহজে অনুমেয়। আর রওশন এরশাদের গেম শুরুতেই মার খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর পরিবার, বিশেষ করে তার বোন, ছেলে ও মেয়ে একতরফা নির্বাচন করতে বাধা দেবেন। কারণ কম্বোডিয়ার প্রেসিডেন্ট বা এল সালভাদরের দুজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে যেভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর পরিবার চাইবে না তাদের বাকি জীবন নরকে পরিণত হোক। সুতরাং পারিবারিক আপত্তি, মার্কিন চাপ, বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন এবং দলীয় কর্মীদের মনোবল কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের যেকোনো প্রকার সমঝোতায় আসার সম্ভাবনাই বেশি। অবশ্য সমঝোতায় পৌঁছার আগে আওয়ামী লীগ নিশ্চিত করে নেবে কোনো প্রকার হানাহানি বা তাদের প্রতি কোনো প্রকার প্রতিহিংসার ঘটনা যেন না ঘটে।
দ্বিতীয় দৃশ্যপট : সম্ভাবনা ২০%। আওয়ামী লীগ সরকার সমঝোতার অংশ হিসেবে বিএনপিকে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী বানিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেওয়ার প্রস্তাব করতে পারে। কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাঙ্ক আন্দালিভ রহমান পার্থের ছোট ভাই ড. আশেকুর রহমান শান্ত ডয়েচে ভেলের খালেদ মহিউদ্দিনের অনুষ্ঠানে, আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো বাগাড়ম্বর না করে, পরিষ্কার করে বলেছেন, বিএনপি সংবিধানের মধ্য থেকে যেকোনো প্রস্তাব দিক, আওয়ামী লীগ তা মেনে নেবে। বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইস্যুতে অনড় থাকলে সরকার আরেকটু ছাড় দিয়ে স্পিকার বা প্রেসিডেন্টের অধীনে নির্বাচনে আসার প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু বিএনপি সরকারকে কোনো প্রকার ছাড় না দিতে চাইলে সরকারও হার্ডলাইনে গিয়ে এককভাবে নির্বাচনের দিকে এগোতে চাইবে। তাতে বিরোধী দলগুলোও হিংসাত্মক কর্মসূচি দেওয়ার চেষ্টা করবে আর সরকারও কঠোর হস্তে দমন করতে গিয়ে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটার শঙ্কা থাকবে। এ অবস্থায় দেশের সবচেয়ে পাওয়ারফুল অংশ হস্তক্ষেপ করে নিজেরা ক্ষমতা নিতে পারে বা তৃতীয় কোনো পক্ষকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আওয়ামী লীগের।
তৃতীয় দৃশ্যপট : সম্ভাবনা ১০%। বঙ্গবন্ধু-কন্যা ব্যক্তিগতভাবে প্রচÐ জেদি। তিনি সব ধরনের চাপ, অনুরোধ ও বাস্তবতা উপেক্ষা করে, কোনো আপসের প্রস্তাব না দিয়ে, কেউ আসুক বা না আসুক বা কত পারসেন্ট ভোট পড়ল তার তোয়াক্কা না করে, প্রচন্ড অনুগত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করিয়ে নিয়ে নিজেই আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা অবশ্যম্ভাবী, দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যাবে, দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে এবং একটা পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে। এতে আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সাধিত হবে এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবার থেকে কেউ নেতৃত্ব নিতে না পারলে আওয়ামী লীগ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
শেষ কথা : যে আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছে, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে বহু কর্মীকে আত্মাহুতি দিতে দিয়েছে, দলীয় কর্মীরা শেখ হাসিনাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে, সে আওয়ামী লীগ কেন আজ একটা অনৈতিকতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জেদ ধরে বসে আছে? যে আওয়ামী লীগ ছিল জনগণের দল, সে আওয়ামী লীগ কেন আজ একদল ধনকুবের, আমলা ও পুলিশের দলে পরিণত হলো? কেনই-বা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বলতে হয়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে এক রাতের মধ্যেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে। বিএনপি কি আগে কখনো আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসেনি? কেনই-বা পশ্চিমারা বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা, বিশেষ করে ভিসানীতি দেওয়ার সুযোগ পায়? এসবের জবাব অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও সত্য, ক্ষমতার মোহই আওয়ামী লীগকে এ পর্যায়ে টেনে এনেছে। শুধু ক্ষমতার মোহ নিয়ে থাকলে আওয়ামী লীগ টিকতে পারবে না। অথচ বাংলাদেশের জন্য আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখা জরুরি। এখনো পর্যাপ্ত সময় রয়েছে, সবার সঙ্গে একটা সমঝোতায় এসে দেশটাকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে পারলে দেশ এবং আওয়ামী লীগ উভয়ের জন্যই মঙ্গল।
লেখক : মফিজুল হুসাইন, যুক্তরাষ্ট্রবাসী