খুলনায় আধুনিক কারাগার নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয় ২০১১ সালে। ৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দফায় দফায় ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ১৪৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকার প্রকল্প ব্যয় বেড়ে ২৮৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা হলেও শেষ হয়নি নির্মাণ কাজ।
সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পেরিমিটার ওয়াল ও ভবনগুলোর অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। চারতলা হাসপাতাল ভবন, দোতলা স্কুলভবন ও গেটের ফিনিশিং কাজ চলছে। তবে অভ্যন্তরীণ সড়ক ও ড্রেন নির্মাণকাজ এখনো অসমাপ্ত রয়েছে।
প্রকল্পটির কাজের এ দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নাগরিক নেতারা। তারা বলছেন, খুলনার ৬০৮ জন ধারণক্ষমতার কারাগারে এখন বন্দীর সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ জন। কখনো কখনো এ সংখ্যা ধারণক্ষমতার তিন গুণ ছাড়িয়ে যায়। ফলে বন্দীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মানবাধিকারও লঙ্ঘন হচ্ছে।
খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি আশরাফ উজ জামান বলেন, খুলনার বড় বড় কাজগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। নতুন কারাগার নির্মাণ প্রকল্পও তার মধ্যে অন্যতম। এতে বন্দিরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
খুলনা টিআইবির সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিয়েছে। ৬০৮ জন ধারণক্ষমতার কারাগারে এখন বন্দির সংখ্যা অন্তত তিন গুণ। ফলে বন্দিদের অনেক কষ্টে থাকতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, ধারণ ক্ষমতার অনেক বেশি কয়েদি থাকছে খুলনা জেলা কারাগারে। বন্দিদের ন্যূনতম মানবিক সেবা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব মো. বাবুল হাওলদার বলেন, দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়লেও খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া দুখঃজনক। এতে বন্দীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত বিভাগ-২ খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু জাফর সিদ্দিক বলেন, কারাগার হবে সংশোধনাগার এমন উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কারাগারটি নির্মিত হচ্ছে। করোনা, জমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও নকশায় ত্রুটির কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। তবে বর্তমানে অবকাঠামোর গড়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
প্রকৌশলী আবু জাফর বলেন, কিছু ভবনে ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সড়কের ৩৫ শতাংশ ও ড্রেনের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি ২০২৪ সালের জুনের মধ্যেই হস্তান্তর করা সম্ভব হবে।
গণপূর্ত দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নগরের ভৈরব নদের তীরে ১৯০৬ সালে খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ করা হয়। কারাগারটি জরাজীর্ণ ও বন্দীদের জায়গার সংকুলান না হওয়ায় ২০০৮ সালে সিটি বাইপাস সড়কের জয় বাংলা মোড়ের অদূরে চক মথুরাবাদের হাসানখালী মৌজায় ৩০ একর জমিতে আধুনিক কারাগার নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১৪৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের ৩০ জুন। কিন্তু জমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও নকশায় ত্রুটির কারণে ২০১৭ সালের ৬ জুন প্রকল্পটি প্রথমদফা সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫১ কোটি ২ লাখ টাকা। কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১৯ সালের ৩০ জুন। তবে সেই মেয়াদেও কাজ শেষ হয়নি।
এরপর ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই ২০২০ সালের ৩০ জুন, ২০২১ সালের ৩০ জুন ও ২০২২ সালের ৩০ জুন, অর্থাৎ তিন দফায় তিন বছর সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু তিন বছর পার হলেও কাজ শেষ হয়নি। এ কারণে ২০২২ সালে দ্বিতীয় দফা প্রকল্প সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। কাজের মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের ৩০ জুন। কিন্তু এই মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া ফের সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী এ প্রকল্পে ৩৯টি অঙ্গ রয়েছে। এখানে চার হাজার বন্দী রাখা যাবে। তবে আপাতত দুই হাজার বন্দী রাখার অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। এখানে বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের পৃথক স্থানে রাখা হবে। কিশোর ও কিশোরী বন্দীদের জন্য রয়েছে পৃথক ব্যারাক। নারীদের জন্য পৃথক হাসপাতাল, মোটিভেশন সেন্টার ও ওয়ার্কশেড। একইভাবে পুরুষ বন্দীদের জন্য ৫০ শয্যার হাসপাতাল এবং কারারক্ষীর সন্তানদের জন্য স্কুল, লাইব্রেরি, ডাইনিং রুম, আধুনিক সেলুন ও লন্ড্রি থাকবে।